আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল (জন্ম নভেম্বর ৯, ১৮৭৭; শিয়ালকোট, পাঞ্জাব - মৃত্যু: এপ্রিল ২১, ১৯৩৮) বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষের মুসলিম কবি, দার্শনিক এবং
রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাঁর ফার্সি ও উর্দু কবিতা[১] আধুনিক যুগের ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে অন্যতম
শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[১][২]ইকবাল তাঁর ধর্মীয় ও ইসলামের রাজনৈতিক
দর্শনের জন্যও বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত চিন্তা দর্শন হচ্ছে
ভারতের মুসলমানদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন। এই চিন্তাই বর্তমান পাকিস্তান
রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। তাঁর নাম মুহাম্মদ ইকবাল হলেও তিনি আল্লামা
ইকবাল হিসেবেই অধিক পরিচিত। আল্লামা শব্দের অর্থ হচ্ছে শিক্ষাবিদ । তাঁর ফার্সি
সৃজনশীলতার জন্য ইরানেও তিনি ছিলেন সমধিক প্রসিদ্ধ; তিনি ইরানে ইকবাল-ই-লাহোরী নামে পরিচিত।
পরিচ্ছেদসমূহ
[লুকিয়ে রাখুন]
ইকবাল-এর পিতামহ শেখ রফিক কাশ্মির হতে
শিয়ালকোটে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। শেখ রফিক কাশ্মিরী শাল তৈরি এবং ব্যবসার সাথে
জড়িত ছিলেন। তাঁর দু’জন পুত্র ছিলেন শেখ গোলাম কাদির এবং শেখ নুর
মোহাম্মদ। শেখ নুর মোহাম্মদ ছিলেন ইকবালের পিতা। তিনি ছিলেন শিয়ালকোটের নামকরা
দর্জি। শেখ নুর মোহাম্মদ কেবল পেশাগত দিক দিয়ে নয়, চিন্তাধারা এবং
জীবন যাপনে ছিলেন ইসলামের প্রতি অত্যন্ত নিবেদিত-প্রাণ। সুফি সঙ্গীদের কাছে তাঁর
প্রচণ্ড সম্মান ছিল। তাঁর স্ত্রী,
মোহাম্মদ
ইকবালের মা ইমাম বিবিও ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা। এই দম্পতি তাদের পাঁচ
সন্তানের মধ্যে ইসলাম ধর্মের প্রতি গভীর অনুভূতির জন্ম দিয়েছিলেন।
১৮৯৯-এ ইকবাল
পাঞ্জাবের বৃটিশ আর্মির কাছে শিখদের পরাজয়ের
পর খ্রিষ্টান মিশনারিরা শিয়ালকোটে শিক্ষা প্রচারের উপর গুরুত্ব দিতে শুরু করেন।
এই সময়েই শিয়ালকোটে স্কটিশ মিশন কলেজ স্থাপিত হয়। ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজ
লিবারেল আর্টস্ এর কোর্সসমূহের অনেকগুলোতেই আরবি ও ফার্সি ভাষা মাধ্যমে শিক্ষাদান
করা হতো। যদিও এই সময় বেশির ভাগ স্কুলেই ফার্সি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। এই স্কটিশ মিশন কলেজেই ইকবাল সর্বপ্রথম
আধুনিক শিক্ষা প্রাপ্ত হন।
ইকবাল তাঁর কাব্য প্রতিভার স্বীকৃতি পান তাঁর
শিক্ষক সাইয়িদ মীর হাসানের কাছ থেকে। ১৮৯২ সালে ইকবাল স্কটিশ মিশন কলেজ হতে তাঁর
পড়াশোন শেষ করেন। একই বৎসরে গুজরাটি চিকিৎসকের মেয়ে করিম বিবির সাথে তাঁর বিয়ে
হয়। তাঁদের বিচ্ছেদ হয় ১৯১৬ সালে । এই বিয়েতে ইকবালের তিনটি সন্তান ছিল।
১৮৮৫ সালে স্কটিশ মিশন কলেজের পড়াশোনা শেষ
করে ইকবাল লাহোরের সরকারি কলেজে ভর্তি হন। দর্শন, ইংরেজি ও আরবি
সাহিত্য নিয়ে তিনি পড়াশোনা করেন এখান থেকে তিনি স্বর্ণ পদক নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি
লাভ করেন। ১৮৯৯সালে যখন তিনি মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন
ততদিনে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত ব্যক্তিত্ব।
মাস্টার্স ডিগ্রিতে পড়বার সময় ইকবাল স্যার
টমাস আর্নল্ড এর সংস্পর্শে আসেন। এই শিক্ষাবিদ ইসলাম ও আধুনিক দর্শনে বুৎপত্তি
অর্জন করেছিলেন। ইকবালের কাছে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ
করেছিলেন। স্যার টমাস আর্নল্ডই ইকবালকে ইউরোপে উচ্চ শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
ইকবাল ১৯০৫ সাল হতে লন্ডনে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু
করেন । তিন বৎসরের আইনের ডিগ্রি লাভ করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিঙ্কনস্ ইন
হতে। আর ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় হতে।
বৃটেনে থাকতেই ইকবাল সর্বপ্রথম রাজনীতির
সংস্পর্শে আসেন। ১৯০৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হবার
পরপরই তিনি তাতে যোগ দেন। দলের বৃটিশ চ্যাপ্টারের এক্সিকিউটিভ কমিটিতে নির্বাচিত
হন ইকবাল। সৈয়দ হাসান বিলগামী এবং সৈয়দ আমির আলির সাথে তিনি সাব-কমিটির সদস্য
হিসেবে মুসলিম লীগের খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করেন। এর পর ১৯২৬ সালে তিনি লাহোরের মুসলিম লীগের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
করে নির্বাচিত হন।
১৯০৮ সালে ইকবাল ইউরোপ হতে দেশে ফিরে আসেন এবং
লাহোরের সরকারি কলেজে যোগদান করেন। এই সময় একই সাথে তিনি আইন ব্যবসা, শিক্ষাদান ও সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। কিন্তু মূলত অর্থনৈতিক কারণেই তিনি ১৯০৯ সালে তিনি সার্বক্ষণিক আইন পেশায় নিয়োজিত
হন। কিন্তু আয় রোজগারের ক্ষেত্রে এখানেও তিনি তেমন ভালো করতে পারেন নি। এর কারণ
তাঁর সাহিত্য প্রীতি এবং সেজন্যে সময় ব্যয় করা। তিনি তাঁর পিতাকে প্রতিজ্ঞা
করেছিলেন যে কবিতার বিনিময়ে কোনো অর্থ তিনি গ্রহণ করবেন না। অর্থনৈতিক দুরবস্থার
কারণে তিনি সে প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেন নি। ইতোমধ্যেই বিখ্যাত কবি ইকবালকে বৃটিশ
সরকার তাঁকে “আসরার-ই-খোদায়ী” পুস্তকের জন্য নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন।
আল্লামা ইকবাল অমর হয়ে আছেন তার কয়েকটি
কবিতা ও রচনার জন্য। এরমধ্যে আসরার ই খুদি, শিকওয়া ও জবাবে
শিকওয়া, দ্যা রিকনস্ট্রাকশন ওফ রিলিজিয়াস থট ইন
ইসলাম, বাআল ই জিবরাইল, জাভেদ নামা, ইত্যাদি অত্যন্ত গভীর দার্শনিক ভাব সমৃদ্ধ
রচনা। আল্লামা ইকবালের লেখনিতে যে ইসলামী পুনর্জাগরণের আওয়াজ উঠেছিল তা সমসাময়িক
অনেক ব্যক্তি ও আন্দোলনকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করেছে। তার দর্শনে প্রভাবিত
হয়েছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ যিনি পাকিস্তানের কায়েদে আজম। তার ইসলামী
পুনর্জাগরণের চেতনাকে সারা জীবনের তরে জীবনোদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে একটি
পুনর্জাগরণী দলের জন্ম দেন তার স্নেহধন্য সৈয়দ আবুল আ'লা মওদুদি। যার প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলামী
পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখেছিল[৩]আল্লামা ইকবাল শিয়া চিন্তানায়কদেরকেও
প্রভাবিত করেছিলেন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের চিন্তানায়ক ড. আলি শরিয়তিও আল্লামা
ইকবাল দ্বারা সাংঘাতিক প্রভাবিত ছিলেন[৪]
আল্লামা ইকবালের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ :
1.
ইলম আল ইক্তিউদ (The Science of Economics)- উর্দু ছন্দে (ca ১৯০১)
2.
Islam as an Ethical and Political Ideal- ইংরেজি (১৯০৮)
3.
The Development of Metaphysics in Persia- ইংরেজি (১৯০৮) ( বাংলা অনুবাদ : প্রজ্ঞান
চর্চায় ইরান)
4.
আসরার ই খুদি (The Secrets of the Self)- ফার্সি (১৯১৫)
5.
রুমিজ ই বেখুদি (The Mysteries of Selflessness)- ফার্সি (১৯১৭)
6.
পয়গাম ই মাশরিক (The Message of the East)- ফার্সি (১৯২৩)
7.
বাং ই দারা (The Call of the Marching Bell)- উর্দু ও ফার্সি (১৯২৪)
8.
জুবুর ই আজাম (The Psalms of Persia)- ফার্সি (১৯২৭)
9.
The Reconstruction of Religious Thought in Islam- (ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন) (১৯৩০)
10.
জাভেদ নামা (The Book of Eternity)- ফার্সি (১৯৩২)
11.
বাল ই জিবরাইল (The Gabriel’s Wings)- উর্দু ও ফার্সি (১৯৩৩)
12.
পাস ছে বায়াদ কারদ আই আক্বওয়াম ই শারক (So What Should be Done O Oriental
Nations)- ফার্সি (১৯৩৬)-
13.
মুসাফির (The Wayfarer)- ফার্সি (১৯৩৬)
14.
জারব ই কালিম (The Blow of Moses) উর্দু ও ফার্সি (১৯৩৬)
No comments:
Post a Comment