হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির (র.)
ভারত উপমহাদেশে
বিশেষ করে বাংলাদেশে যে সমস্ত ওলীয়ে কামেল ইসলাম প্রচারের জন্য আগমন করেছেন এবং
ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে হযরত উলূঘ খান জাহান(র.)
নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। এ মহান মনীষীর সাথে যে সমস্ত শিষ্যগণ ছিলেন তাঁরাও স্ব
স্ব মহিমায় খ্যাতিমান হয়ে আছেন। কিন্তু এই বাংলার সন্তান একেবারে খাস বাঙালী কোন
শিষ্য, হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির (র.) এর মত
যশস্বী হতে পারেন নি।
আনুমানিক পঞ্চদশ
শতাব্দীর গোড়ার দিকে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে মুহাম্মদ তাহির জন্মগ্রহণ করেন। এ
সম্বন্ধে নীলকান্ত বলেছেন-
‘পীর আলী নাম ধরে পীরাল্যা গ্রামে বাস
যে গাঁয়েতে
নবদ্বীপের হইলো সর্বনাশ।’
তাঁর পূর্ব নাম
ছিল গোবিন্দ ঠাকুর। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মিত্র তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে তাঁকে খাট
চোখে দেখার প্রয়াস পেয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘তাঁহার পূবে কি
নাম ছিল জানিনা, জানিয়াও কোন কাজ নেই। এখন তাঁহার নাম
তাহির।(যশোহর খুলনার ইতিহাস. ১ম খন্ড ৩৩৩ পৃষ্ঠা, শ্রী সতীশ
চন্দ্র মিত্র)। অবশ্য এ.এফ.এম. আবদুল জলীল সাহেব এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বহুদিন অনুসন্ধানের পর জানিতে পারিয়াছি যে, এই ব্রাহ্মণ
সন্তানের পূর্ব নাম ছিল গোবিন্দলাল রায়। তিনি গোবিন্দ ঠাকুর নামেই পরিচিত ছিলেন।
ইনি খান জাহানের বিশেষ প্রিয় পাত্র ও আমত্য ছিলেন।’(সুন্দরবনের
ইতিহাস, ২য় খন্ড, ১১৮ পৃষ্ঠা-এ.এফ.এম.
আবদুল জলীল)। তিনি হযরত উলুঘ খান জাহান আলী(র.) এর পরশে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং
প্রধান সহচরে পরিণত হন। হযরত উলুঘ খান জাহান আলীর এ দেশীয় শিষ্যদের মধ্যে হযরত পীর
অলী মুহাম্মদ তাহিরই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও জননন্দিত ছিলেন। তাঁর হাতে হাজার হাজার
অমুসলিম ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন। এই নবদীক্ষিত মুসলমারা পীরেলি নামে পরিচিত হন।
পীরেলি
সম্প্রদায়ের উৎপত্তি সম্বন্ধে এ. এফ. এম. আবদুল জলীল সাহেব লিখেছেন, ‘পয়গ্রাম কসবায় বিখ্যাত পীর অলি সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়। যশোহর অঞ্চলের একজন
ব্রাহ্মণ খান জাহানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া ইসলাম কবুল করেন। তাঁহার নাম মুহাম্মদ
তাহের। এই ব্রাহ্মণ সন্তানের পূর্ব পরিচয় অস্পষ্ট। সতীশ বাবু তাহার সম্বন্ধে
লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণ পরহিংসা করিতে গিয়ো আত্মহিংসাই
করিয়াছেন। কারণ তিনি ধর্ম বা রাজ্য লাভে অথবা সংস্পর্শ দোষে নিজের জাতি ধর্ম
বিসর্জন দিয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।’(সুন্দরবনের
ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড ৩৩২, এ.এফ.এম আবদুল জলীল)। এ. এফ. এম. আবদুল জলীল অন্যত্র লিখেছেন-‘খুলনা জেলার দক্ষিণ ডিহি প্রাচীন হিন্দু প্রধান। সেনহাটি, মুলঘর কালিয়া প্রভৃতি স্থানের বহুপূর্বে এখানে
উচ্চশ্রেণীর বসবাস ছিল। এই গ্রামের নাম ছিল পয়োগ্রাম, এখনও এ নাম আছে। এখানকার রায় চৌধুরী বংশের তৎকালে বিশেষ খ্যাতি ছিল। সম্ভবতঃ
তুর্ক আফগান আমলের প্রথম দিকে এ ব্রাহ্মণ বংশ রাজ সরকার হইতে সম্মানসূচক রায়
চৌধুরী উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ইহারা কনোজাগত ব্রাহ্মণ। ইহাদের পূর্ব পুরুষ গুড়
গ্রামের অধিবাসী বলিয়া ইহার গুড়ি বা গুড়গাঞী ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত। এই বংশের
কৃতি সন্তান দক্ষিণা নারায়ণ ও নাগরা নাথ। কথিত আছে যে দক্ষিণা নারায়ণ দক্ষিণ ডিহি
এবং নাগর উত্তর ডিহির সম্পত্তি ভাগ করিয়া লইয়াছিলেন।
দক্ষিণ ডিহি
নামের সহিত দক্ষিণা নারায়ণের সম্পর্ক আছে বলিয়া অনেকে মনে করেন। নাগর বেজের
ডাঙ্গায় একটি হাট বসাইয়াছিলেন। উহার নাগরের হাট নামে পরিচিত ছিল। খান জাহানের আমলে
চৌধুরীগণ সমাজে সম্মানিত ছিলেন। নাগর নিঃসন্তান। ভ্রাতা দক্ষিণা নারায়ণের
চারিপুত্র ছিল। তাহাদের নাম যথাক্রমে কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। কামদেব ও জয়দেব এই নবগত শাসনকর্তার অধীনে উচ্চপদ গ্রহণ করেন।
কথিত আছে যে, মোহাম্মদ তাহেরের চেষ্টায় তাহারা ইসলাম গ্রহণ
করিয়াছিলেন এবং এই ঘটনাই ইতিহাসে পীরালিদের উৎপত্তি বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে।
(সুন্দরবনের ইতিহাস, দ্বিতীয় খন্ড ৩৩২, এ.এফ.এম আবদুল জলীল)।
এ সম্পর্কে মি.
ওমালি বলেন, ‘খান জাহান একদা রোজার সময় ফুলের ঘ্রাণ নিতে
থাকেন। ইহাতে তদীয় হিন্দু কর্মচারী মোহাম্মদ তাহের (তখনও ইসলাম গ্রহণ করেন নি)
বলেন যে, ‘ঘ্রাণেন কার্ধ বোজনং’ অর্থাৎ ঘ্রাণে অর্ধভোজন। খান জাহান পরে একদিন খানাপিনার আয়োজন করেন। মাংসের
গন্ধে তাহার নাকে কাপড় দিলে খান জাহান বলেন, যখন ঘ্রাণে
অর্ধভোজন তখন এই খানা ভক্ষণের পর আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন। তদনুসারে তাহের ইসলাম
গ্রহণ করেন। কথিত আছে যে, তাহেরের ইসলাম গ্রহণের পূর্বে যে পুত্র
সন্তান ছিলেন তিনি হিন্দু থাকিয়া যান। তিনিই সর্বপ্রথম হিন্দু পীরালি এবং তাহেরকে
লোকে উপহাসচ্ছলে পীরালি বলত। তাঁহাকেই কেন্দ্র করিয়া এদেশে পীরালি গান এবং বহু
কাহিনী রচিত হয়। ঐকান্তিক ধর্ম নিষ্ঠার জন্য শেষ পর্যন্ত তাহের পীরালি আখ্যা পান।”(সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৩/৩৩৪ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)।
অন্য এক বর্ণনা
মতে “মোহাম্মদ তাহেরের সঙ্গে জয়দেব ও কাবদেব এর
অন্তরের মিল ছিল না। তাহের মনে মনে তাঁহাদিগকে মুসলমান করার চেষ্টা করিতেন। এ
সম্পর্কে এতদঞ্চলে একটি গল্প প্রচলিত আছে, তাহা কতটুকু
সত্য তাহা জানি না। গল্পটি বর্ণনা করিতেছি-একদিন রমজানের সময় তাহের রোজা
রাখিয়াছেন। দরবার গৃহে জয়দেব ও কামদেব অন্যান্য কর্মচারীসহ বসিয়া আছেন। এমন সময় এক
ব্যক্তি তাঁহার বাটি হইতে একটি সুগন্ধী নেবু আনিয়া তাহাকে উপহার দেন। পীরআলী নেবুর
ঘ্রাণ লইতেছিলেন। এমন সময় কামদেব বলিলেন হুজুর, ঘ্রাণে
অর্ধভোজন-আপনি গন্ধ শুকিয়া রোজা ভাঙ্গিয়া ফেলিলেন? এ কথার পর
পীরআলী ব্রাহ্মণের প্রতি চটিয়া যান। গোপনে পরামর্শ করিয়া স্থির হইল যে, একদিন তিনি সমস্ত কর্মচারীদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া আহার করাইবেন। নির্ধারিত দিনে
কামদেব ও জয়দেব সভাস্থলে উপস্থিত হইলেন। সভাগৃহের প্রাঙ্গনে গো-মাংসের সহিত
নানারকম মশলা দিয়া রন্ধনকার্য্ ধুমধামের সহিত চলিল। রান্নার গন্ধে সভাগৃহ ভরপুর।
জয়দেব ও কামদেব নাকে কাপড় দিয়া প্রতিরোধ করিতেছিলেন। পীরআলী নাকে কাপড় কেন
জিজ্ঞাসা করিলে কামদের মাংস রন্ধনের কথা উল্লেখ করেন। পীরআলী নেবুর গল্প উল্লেখ
করিয়া বলেন-‘এখানে গো-মাংস রান্না হইতেছে। ইহাতে আপনার
অর্ধেক ভোজন হয়ে গিয়েছে। সুতরাং আপনি জাতিচ্যূত হইয়াছেন।’
অতঃপর জয়দেব ও
কামদেব উক্ত মাংস খাইয়া মুসলমান হইয়া গেলেন। পীরআলী তাঁহাদিগকে জামাল উদ্দীন, কামাল উদ্দীন খাঁ চৌধুরী উপাধি দিয়া আমত্য শ্রেণীভুক্ত করিয়া লইলেন। সংশ্রব
দোষে অন্য দু্ই ভ্রাতা শুকদেব ও রতিদেব পীরালি ব্রাহ্মণ নামে সমাজে পরিচিত হইলেন।
ইহাই পীরালি সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিকথা।’ (সুন্দরবনের
ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৩/৩৩৪ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)।
এ প্রসঙ্গে জনৈক
নীলকান্তের বরাত দিয়ে ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থে ঘটকদিগের পুঁথি থেকে কিছু উল্লেখ করেছেন, তা হল-
খানজাহান মহামান
পাতশা নফর।
যশোর সনন্দে লয়ে
করিল সফর।।
তার মুখ্য
মহাপাত্র মামুদ তাহির।
মারিতে বামুন
বেটা হইল হাজির।।
পূর্বেতে আছিল
সেও কুলীনের নাতি।
মুসলমানী রূপে
মজে হারাইল জাতি।।
পীর আলী নাম ধরে
পীরাল্যা গ্রামে বাস।
যে গাঁয়েতে
নবদ্বীপের হইল সর্বনাশ।।
সুবিধা পাইয়া
তাহির হইল উজীর।
চেঙ্গুটিয়া পরগণায়
হইল হাজির।।
এখানে লেখক খান
জাহানকে কোন মুসলমান সুলতানের সনদ প্রাপ্ত প্রশাসক বলে উল্লেখ করেছেন। এরপর
মুহাম্মদ তাহিরের পরিচয় তুলে ধরে বলতে চেয়েছেন ইসলামের আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে নয় বরং
কোন নারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে সে মুসলমান হয়েছে। প্রকারান্তরে লেখক(সম্ভবত) বলতে চেয়েছেন
ইসলাম প্রচার এদেশে কৌশলে হয়েছে। পুঁথির অন্যত্র এ ব্যাপারে বলা হয়েছে-
আঙ্গিনায় বসে
আছে উজির তাহির।
কত প্রজা লয়ে
ভেট করিছে হাজির।।
রোজার সে দিন
পীর উপবাস ছিল।
হেনকালে একজন
নেবু এনে দিল।।
গন্ধামোদে
চারিদিক ভরপুর হইল।
বাহবা বাহবা বলে
নাকেতে ধরিল।।
কামদেব জয়দেব
পাত্র দুইজন।
বসে ছিল সেইখানে
বুদ্ধি বিচক্ষণ।।
কি করেন কি করেন
বলিলা তাহিরে।
ঘ্রাণেতে অর্ধেক
ভোজন শাস্ত্রের বিচারে।।
কথায় বিদ্রূপ
ভাবি তাহির অস্থির।
গোঁড়ামি
ভাঙ্গিতে দোহের মনে কৈলা স্থির।।
দিন পরে মজলিস
করিল তাহির।
জয়দেব কামদেব
হইল হাজির।।
দরবারের
চারিদিকে ভোজের আয়োজন।
শত শত বকরী আর
গো-মাংস রন্ধন।।
পলান্ডু রশুন
গন্ধে সভা ভরপুর।
সেই সভায় ছিল
আরও ব্রাহ্মণ প্রচুর।।
নাকে বস্ত্র
দিয়া সবে প্রমাদ গণিল।
ফাঁকি দিয়া ছলে
বলে কত পালাইল।।
কামদেব জয়দেব
করি সম্বোধন।
হাসিয়া কহিল
ধূর্ত তাহির তখন।।
জারি জুরি চৌধুরী
আর নাহি খাটে।
ঘ্রাণে অর্ধেক
ভোজন শাস্ত্রে আছে বটে।।
নাকে হাত দিলে
আর ফাঁকি তো চলে না।
এখন ছেড়ে ঢং
আমার সাথে কর খানাপিনা।।
উপায় না ভাবিয়া
দোহে প্রমাদ গণিল।
হিতে বিপরীত
দেখি শরমে মরিল।।
পাকড়াও পাকড়াও
হাঁক দিল পীর।
থতমত খেয়ে দোহ
হইল অস্থির।।
দুইজনে ধরি পীর
খাওয়াইল গোস্ত।
পীরালি হইল
তাঁরা হইল জাতি ভ্রষ্ট।।
কামাল জামাল নাম
হইল দোহার।
ব্রাহ্মণ সমাজে
পড়ে গেল হাহাকার।।
তখন ডাকিয়া দোহে
আলী খানজাহান।
সিঙ্গির জায়গীর
দিল করিতে বাখান।।
‘নবদীক্ষিত জামালউদ্দীন ও কামাল উদ্দীন প্রচুর
সম্পত্তির জায়গীর পাইয়া সিঙ্গিয়া অঞ্চলে বাস করিতে থাকেন। তাঁহাদের ইসলাম গ্রহণ
খুব সম্ভব খান জাহানের পয়গাম তৈরির পরেই হয়েছে। কথিত আছে খান জাহান তাঁহাদিগকে
উচ্চ সম্মানে সম্মানিত করিয়াছিলেন। তিনি বাগেরহাট অবস্থানকালে এই দুই ভ্রাতা মধ্যে
মধ্যে তাঁহার সহিত সাক্ষাত করিতে তথায় আসিতেন। বাগের হাটের পশ্চিমে সোনাতলা গ্রামে
আজিও কামাল খাঁ নামীয় দীঘি তাঁহার স্মৃতি রক্ষা করিতেছে।’ (সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৬ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)।
ছল ছাতুরী বা
কলা কৌশল নয় ইসলামের সুমহান আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই হযরত পীর আলী মুহাম্মদ
তাহিরের হাতে হাজার হাজার অমুসলিম ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেন। এই নবদীক্ষিত মুসলমানরা
পীরেলি নামে পরিচিত হন। আর যে হিন্দু মুসলমান হতেন, তার হিন্দু
আত্মীয়রা ঐ বংশের লোকদেরকে সমাজচ্যূত করত। তারা পীরেলি ব্রাহ্মণ বা পীরেলি কায়স্থ
নামে পরিচিত হন। এই পীরেলিদেরকে কুলীণ ব্রাহ্মণরা ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বলতেন-
মোসলমানের গোস্ত
ভাতে
জাত গেল তোর পথে
পথে
ওরেও পীরেলী
বামন।
জানা যায়, ‘পীরেলি সম্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য বহন করতো। তাই
দেখতে পাই, কলকাতার জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবার, সিঙ্গিয়ার মুস্তফী পরিবার,
দক্ষিণ ডিহির
রায় চৌধুরী পরিবার, খুলনার পিঠাভোগের ঠাকুর পরিবার, এই পীরালিদের উত্তরাধিকার হিসাবে চিহ্নিত। কবি রবীন্দ্রনাথও এই পীরালি ঠাকুর
পরিবারেই সন্তান।
সংশ্রব দোষে রায়
চৌধুরী পরিবারের লোকেরা পুত্র কন্যার বিবাহ লইয়া বিড়ম্বিত হইয়া পড়ে। তখন তাহারা
প্রতিপত্তি ও অর্থ বলে সমাজকে বাধ্য করিবার জন্য চেষ্টা চালাইতে লাগিল। ইহাদের
সহিত কলিকাতার ঠাকুর বংশ এবং আরও কতিপয় বংশ সংশ্রব দোষে পতিত হইয়াছিল। কলিকাতার
ঠাকুরগণ ভট্টনারায়ণের সন্তান এবং কুশারী গাঁঞিভুক্ত ব্রাহ্মণ। খুলনা জেলার
আলাইপুরের পূর্বদিকে পিঠাভোগে কুশারীদের পূর্ব নিবাস ছিল। পীঠাভোগের কুশারীগণ রায়
চৌধুরীদের সহিত আত্মীয়তা করিয়া পীরালি হন।’ (সুন্দরবনের
ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৭ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)। ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’, ব্রাহ্মণ কান্ড, তৃতীয় ভাগ, ষষ্ঠ অংশের ১৭২
পৃষ্ঠায় এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে,
‘বর্তমান কালে
খুলনা জেলার অন্তর্গত পিঠাভোগ গ্রামের কুশারী মহাশয়েরা চেঙ্গুটিয়ার গুড় চৌধুরীগণের
ন্যায় শক্তিশালী প্রবল শ্রোত্রিয় জমিদার ছিলেন। ইহারা শান্ডিল্য ভট্টনারায়ণ পুত্র
দীন কুশারীর বংশধর। যে সময় শুকদেব রায় চৌধুরী বিশেষ বিখ্যাত জমিদার হইয়াছিলেন।ইনি
পিঠাভোগের কুশারী বংশীয় সুপ্রসিদ্ধ শ্রীমন্ত খানের কোন আত্মীয় হওয়াই সম্ভব।’(বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণ কান্ড, তৃতীয় ভাগ ষষ্ঠ অংশের ১৭২ পৃ., নরেন্দ্রনাথ
বসু)।
“কুশারী বংশের পঞ্চানন থেকেই পরবর্তীকালে
কলকাতার বিখ্যাত জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বংশের প্রতিষ্ঠা হয়।”(খুলনা জেলায় ইসলাম, মুহম্মদ আবু তালিব, পৃ. ৭১)।
অন্যদিকে মাওলানা
মুহাম্মদ আকরাম খাঁকে অনেকেই পীরালী বংশোদ্ভুত মনে করেন। এ প্রসঙ্গে এ.এফ.এম.
আবদুল জলীল বলেন, “মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ এই পীরালী বংশের
কৃতি সন্তান। তাঁহার আত্মীয় স্বজন পীরালি খাঁ বলিয়া পরিচিত। আমি মাওলানা সাহেবের
সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করিয়াছি। তাঁহার বংশ পীরালি তাহা তিনি স্বীকার করেন না।
তিনি বলেন যে, গৌড়ের সুলতান যদু বা জালাল উদ্দীনের সময় হইতে
তাঁহারা মুসলমান এবং জনৈক আলী খানের বংশধর। (সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৭ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)।
এ বিষয়ে হান্টার
সাহেব বলেছেন, “সমস্ত রায় চৌধুরীগণ খান চৌধুরীতে পরিণত হয়।
কিন্তু মাওলানা সাহেবের বংশ খান চৌধুরী নহে, শুধু খাঁ
উপাধিধারী।”(সুন্দরবনের ইতিহাস, ৩৩৭ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)।
অন্যত্র
এ.এফ.এম. আবদুল জলিল সাহেব লিখেছেন, ‘কলিকাতা এবং
স্থানীয় সম্ভাব্য সমস্ত সূত্র হইতে জানিয়া আমাদের মন্তব্য সন্নিবেশিত করিলাম। রায়
চৌধুরী বংশের পূর্ব পুরুষদের সহিত রবি বাবুর যেরূপ রক্তের সম্পর্ক, মাওলানা আকরাম খাঁ সাহেবের সম্পর্ক ঠিক ততটুকু।’ (সুন্দরবনের
ইতিহাস, ২য় খন্ড ৩৩৮ পৃ., এ.এফ.এম. আবদুল জলীল)।
“হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির পয়গ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন বলে জানা যায়। জানা যায়, পরে তিনি
খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।”(হযরত খানজাহান
আলী(র), পৃ. ৬-সেলিম আহমদ)।
প্রখ্যাত গবেষক
জনাব অধ্যাপক আবূ তালিব বৈষ্ঞব ধর্মের প্রবক্তা শ্রীচৈতন্যের প্রচারিত আদর্শ
সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, “সত্যি বলতে কি, পীরালি আবু তাহিরই
ছিলেন শ্রীচৈতন্যের পূর্বসূরী। আবূ তাহিরের আবির্ভাব যাদেরকে পবিত্র ইসলাম ধর্মের
দিকে আকৃষ্ট করেছিল, শ্রী চৈতন্য তাদেরকে বৈষ্ঞব ধর্মের প্রতি
আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন।(খুলনা জেলায় ইসলাম, ৬৯ পৃ.-মুহাম্মদ
আবূ তালিব)।
এরপরই তালিব
সাহেব বলেছেন, “ধর্ম প্রচারের ব্যাপারে পীরালী সাহেব
শ্রীচৈতন্যের দিশারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্য তাঁরই পথের অনুসারী
ছিলেন। আরও বলা যেতে পারে, নির্যাতিত হিন্দু পীরালী সমাজ একাধারে
চৈতন্যের ধর্ম ও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে শান্তি প্রাপ্ত হয়েছিলেন।(খুলনা জেলায়
ইসলাম, ৬৯ পৃ.-মুহাম্মদ আবূ তালিব)।
যা হোক পীর আলী
মুহাম্মদ তাহিরের প্রধান কর্মকেন্দ্র হয় পয়গ্রাম কসবায়। “হযরত খানজাহান এই গ্রামটিকে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত রাজধানী শহর করার
সুসংবাদ প্রদান করেন। এবং অবিলম্বে গ্রামটিকে একটি ‘কসবা’ বা শহরে পরিণত করেন। (খুলনা জেলায় ইসলাম, ৬৮ পৃ.-মুহাম্মদ
আবূ তালিব)।
পীর আলী
মুহাম্মদ তাহিরের জন্মস্থান হচ্ছে যশোহর জেলার নড়াইল মহকুমার(বর্তমানে জেলা)
পেড়োলি গ্রামে। হযরত পীর আলী’র নামেই গ্রামটির নামকরণ হয় ‘পীরালী’। বর্তমানে নামটির বিকৃত রূপ হচ্ছে ‘পেড়োলি’।
হযরত পীর আলী’র নিকট এত অধিক সংখ্যক ব্রাহ্মণ মুসলমান হন যে, নবদ্বীপে
ব্রাহ্মণ আর ছিলনা বললেই চলে। এজন্য অন্যান্য হিন্দু ব্রাহ্মণগণ ভয় পেয়ে যান ও
চিন্তিত হয়ে পড়ে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এর স্বাক্ষ্য মেলে-
পীরাল্যা
গ্রামেতে বৈসে যবেত যবন।
উচ্ছন্ন করিল
নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ।।
ব্রাহ্মণ জবনে
বাদ যুগে যুগে আছে।
বিষম পীরাল্যা
গ্রাম নবদ্বীপের কাছে।।
কবি আরো বলেন-
পীর আলী নাম ধরে
পীরাল্যা গ্রামে বাস।
যে গায়েতে
নবদ্বীপের হৈল সর্ববনাস।।
অথবা
“বিষম পীরাল্যা গ্রাম নবদ্বীপের আড়ে।
৮৬৩ হিজরী
মোতাবেক ১৪৫৯ সালে এ মহান কামেলে দ্বীন ও ইসলাম প্রচারক ইন্তিকাল করেন। তাঁর মাজার
বাগেরহাট হযরত উলূঘ খান জাহান আলীর(র) মাজারের পাশেই আছে। এ সম্বন্ধে সতীশ চন্দ্র
মিত্র লিখেছেন, “মুহাম্মদ তাহির এখানে মারা যান নাই, এখানে মাত্র তাঁহার একটি শূন্যগর্ভ সমাধিবেদী গাঁথা রহিয়াছে।…..বন্ধুর স্মৃতি চিহ্ন রাখা কর্তব্য এই বুদ্ধিতে খাঁ জাহান মৃত্যুর অব্যবহিত
পূর্বে সেই একই জেলহ্জ্জ মাসে মুহাম্মদ তাহিরের জন্য এই স্মৃতি স্তম্ভ গঠিত করিয়া
রাখিয়া যান। সমাধির উপরিভাগটি প্রায় খান জাহানে সমাধির ন্যায়, তবে ইহার ভিতরে কিছুই নাই,
সিঁড়ি দিয়া
তন্মধ্যে অবতরণ করা যায়।” (যশোহর খুলনার ইতিহাস, ১ম খন্ড, পৃ. ২৬৮, সতীশ চন্দ্র
মিত্র)। সতীশ বাবুর এই মন্তব্যের সহিত আমরা কোনভাবেই একমত হতে পারিনা। কবরের নীচে
এ ধরনের সুড়ঙ্গের ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রযেছে। তা’ছাড়া আমরা
পূর্বেই তাঁর মৃত্যুর তারিখ উল্লেখ করেছি।
তাঁর শিলালিপিতে
লেখা আছে, “হাজিহি রওজাতুন মুবারাকাতুন মির রিয়াজিল
জান্নাতি ওয়া হাজিহি সাখরিয়া তুল লিহাবীবিহি এসমুহু মুহাম্মদ তাহির ছালাছা
সিত্তিনা ওয়া সামানিয়াতা।” অর্থাৎ এই স্থান বেহেশতের বাগিচা সদৃশ এবং
ইহা জনৈক বন্ধুর মাযার, নাম-আবু তাহির, ওফাতকাল-৮৬৩
হি/১৪৫৯ খৃষ্টাব্দ। এই একই বৎসর হযরত খান জাহান (রঃ) এর ওফাত হয়।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মধ্যমণি
মহাকবি আলাওল
আমরা যাকে নিয়ে
আজ আলোচনা করব তিনি ছিলেন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মধ্যমণি। আধুনিককালেও যাঁকে
মহাকবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এইএই বহুভাষাবিদ পন্ডিত, অনুবাদক মহাকবি আলোচনার পূর্বে তাঁর যুগ সম্বন্ধে জেনে নিলে মনে হয় সবার জন্য
সুবিধা হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরাতন বলে মনে করা হয়। এই হাজার
বছরকে পন্ডিতরা তিন ভাগে ভাগ করেছেন-প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক।
৬৫০ হতে ১২০০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন যুগ, ১২০১ হতে ১৮০০
খৃস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্যযুগ এবং ১৮০১ হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত আধুনিক যুগ। অবশ্য
হিন্দু পন্ডিতরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ১২০১ হতে ১৩৫০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত অন্ধকার যুগ
বলে থাকেন। কারণ এই দেড়শ বছর মুসলমানদের ভারত আগমন তথা বাংলাদেশ দখলের দরুণ কোন
সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি বলে তারা মনে করে। অথচ সত্যি কথা হলো এই সময়েও সাহিত্য সৃষ্টি
হয়েছে। যেমন শূন্য পূরাণ, কলিমা জালাল বা নিরঞ্জনের রুষ্মা, ডাক ও খনার বচন, সেক শুভোদয়া ইত্যাদি।
কবিগুরু মহাকবি
আলাওল বা আলাউল এই মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৫৯৭ খৃস্টাব্দে
কারো কারো মতে ১৬০৫ বা ১৬০৭ খৃস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার জালালপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
অবশ্য দু’একজন পন্ডিত ব্যক্তি আলাওলের জন্মস্থান
চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে বলে মনে করেন। কিন্তু কবির নিজের
উক্তিকে সামনে রেখে প্রায় সকল পন্ডিতগণই ফরিদপুর জেলার জালালপুরের পক্ষে রায়
দিয়েছেন। কবির পিতা ছিলেন ফতেহাবাদের রাজ্যেশ্বর মজলিশ কুতুবের মন্ত্রী। কবি তাঁর
পদ্মাবতী কাব্যে আত্মকথায় লিখেছেন—
মুলুক ফতেয়াবাদ
গৌড়েতে প্রধান।
তাহাতে জালাল
পুর অতি পূণ্যস্থান।।
বহুগুণবন্ত বৈসে
খলিফা ওলেমা।
কথেক কহিব সেই
দেশের মহিমা।।
মজলিস কুতুব তখত
অধিপতি।
মুই দীনহীন তান
অমাত্য সন্তুতি।।
মহাকবি আলাওল
ছিলেন ভাগ্যবিড়ম্বিত এক কবি। তিনি কৈশর বয়সে মন্ত্রী পিতার সাথে কার্যোপলক্ষে
কোথাও যাত্রাকালে পথিমধ্যে দুর্ধর্ষ হার্মাদ জলদস্যূর কবলে পড়েন। কবির পিতা
জলদস্যুদের হাতে শহীদ হন। কবি আহত হলেও প্রাণে রক্ষা পান। এরপর অনেক দুঃখ-কষ্ট
অতিক্রম করে অনেক পথ অতিক্রম করে তিনি আরাকানে এসে উপস্থিত হন। বেঁচে থাকার তাগিদে
কবি মগরাজার সেনাবাহিনীতে রাজ-আসোয়ারের চাকরি গ্রহণ করেন। রাজ আসোয়ার মানে
অশ্বারোহী সৈনিক। এ সময় আরাকান রাজসভায় একটি চমৎকার সাহিত্যিখ আবহাওয়া বিরাজ
করছিল। গুণী ব্যক্তিদেরকে যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখা হত সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক
না কেন। কবি নিজেই লিখেছেন-
বহু বহু মুসলমান
রোসাঙ্গে বৈসন্ত।
সদাচারী, কুলীন, পন্ডিত, গুণবন্ত।।
ফলে অচিরেই কবি
আলাওলের গুণগরিমা, বিদ্যা বুদ্ধি ও সাহিত্য প্রতিভার কথা অভিজাত
মহলে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি আরাকানের প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের আশ্রয় লাভ করেন। কবি
বলেন,
তালিব আলিম বুলি
মুঞি ফকিরেরে।
অন্নবস্ত্র দিয়ে
সবে পোষন্ত আদরে।।
মূলত এখান থেকেই
আলাওলের কাব্য সাধানার শুরু এবং এক আমত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ক্রমাগত ১৬৫১ খৃ.
হতে ১৬৭৩ খৃ. পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। মাঝে কবির উপর বয়ে যায়
অনেক ঝড়ঝঞ্জা। কবিকে অনেক কষ্ট ক্লেশে নিপতিত হতে হয়। ১৬৫৯ খৃ. শাহসূজা বাংলাদেশ
হতে বিতাড়িত হয়ে আরাকান রাজ্যে আশ্রয় লাভ করেন। যে কোন কারণেই হোক ১৬৯১ খৃ. তিনি
আরাকান রাজ্যের বিরাগভাজন হয়ে নিহত হন। এ সময়ে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কবি আলাওল
কারারুদ্ধ হন। পঞ্চাশ দিন কারাভোগের পর কবি মুক্তি পান। কিন্তু প্রতিকুল পরিবেশে
সবাই কবির বিরুদ্ধে চলে যায়,
ফলে তিনি অতি
কষ্টে দিনাতিপাত করতে থাকেন। ঠিক এ সময়ে কবির প্রধান পৃষ্ঠপোষক মাগন ঠাকুরের মৃত্যু হলে কবির দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। এমনকি এ সময় তিনি
ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে
রোসাঙ্গ রাজসভার আমত্য সৈয়দ মূসা,
সমরসচিব সৈয়দ
মুহাম্মদ খান, রাজমন্ত্রী নবরাজ মজলিশ, অন্যতম সচিব শ্রীমন্ত সোলেমান প্রমুখদের নজরে আসেন। ফলে পুনরায় অবস্থার কিছুটা
উন্নতি হয়।
তোমরা জানলে
খুশি হবে যে, সেই যুগেও মহাকবি আলাওলের জানা ছিল অনেকগুলি
ভাষা। তিনি মৈথিল, ব্রজভাখা, ঠেট, খাড়িবোলির মত উত্তর ভারতের উপভাষা ছাড়াও বাংলা, সংস্কৃত, আরবী ও ফারসীতে সমান দখল রাখতেন। অপর দিকে তাসাউফ ও যোগতন্ত্রেও ছিল
পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান। যার কারণে তিনি অনুবাদে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সত্যি কথা বলতে
তাঁর মত অনুবাদক কদাচিৎ দু/একজন মিলে। তিনি কাব্য ক্ষেত্রে ছিলেন স্বচ্ছন্দ্য।
কাব্যতত্ত্ব, অলংকার শাস্ত্র ও ছন্দবিজ্ঞান ছিল তাঁর
আয়ত্ত্বে। এমনকি তিনি কয়েকটি সংস্কৃত ছন্দও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাংলায় প্রয়োগ
করেন। তার রোসাঙ্গে তিনি তো সঙ্গীত শিক্ষক রূপেই পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
আলাওল অনেকগুলো
পুস্তক রচনা করেন। তার মধ্যে-
১. পদ্মাবতীঃ
প্রখ্যাত হিন্দি কবি মালিম মুহাম্মদ জায়সী ‘পদুমাবত’ কাব্যের বঙ্গানুবাদ। ১৬৫১ খৃস্টাব্দে মাগন ঠাকুরের নির্দেশে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ অনুবাদ করেন। এ কাব্যটি আলাওলের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ
কাব্য।
২. সয়ফুলমুলক
বদিউজ্জামানঃ আলাওলের দ্বিতীয় কাব্য। ১৬৫৮ খৃস্টাব্দে মাগন ঠাকুরের পরামর্শে ও
উৎসাহে এ কাব্য লেখা শুরু করেন এবং পরে ১৬৬৯ খৃস্টাব্দে রোসাঙ্গ রাজের আমত্য সৈয়দ
মূসার অনুরোধক্রমে তা সমাপ্ত করেন। এটি প্রেম মূলক কাহিনী কাব্য।
৩. সতীময়না ও
লোরচন্দ্রানীঃ দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য আমত্য সুলায়মানের অনুরোধে ও উৎসাহে ১৬৫৯
খৃস্টাব্দে সমাপ্ত করেন। এ কাব্যগ্রন্থটি আলাওলের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ।
৪. সপ্তপয়কারঃ
পারস্য কবি নিজামীর সপ্তপয়কর নামক কাব্যের ভাবানুবাদ। রোসাঙ্গরাজের সমরমন্ত্রী
সৈয়দ মুহাম্মদের আদেশে ১৬৬০ খৃস্টাব্দে আলাওল এটির অনুবাদ করেন।
৫. তোহফাঃ এ
গ্রন্থটিও অনুবাদ। বিখ্যাত সূফী সাধক শেখ ইউসুফ গদা দেহলভীর ‘তোহফাতুন নেসায়েহ’ নামক ফরাসী গ্রন্থের অনুবাদ। ১৬৬৪ খৃস্টাব্দে
আলাওল এ কাব্যগ্রন্থটি সমাপ্ত করেন। এটি আলাওলের পঞ্চম রচনা।
৬. সেকান্দর
নামাঃ এ ষষ্ঠ নম্বর কাব্যটি নিজামী গঞ্জভীর ফারসী সেকান্দর নামা গ্রন্থের অনুবাদ।
আলাওল এ কাব্যটি সম্ভবত ১৬৭২ খৃস্টাব্দে রচনা করেন। আরাকান রাজ চন্দ্র সুর্ধমার
নবরাজ উপাধীধারী মজলিস নামক জনৈক আমত্যের অনুরোধে আলাওল সেকান্দরনামা অনুবাদ করেন।
সঙ্গীতবিদ
হিসেবেও আলাওলের প্রচুর খ্যাতি ছিল। তিনি সঙ্গীতের শিক্ষক ছিলেন। তিনি বেশ কিছু
গীতও রচনা করেছেন। অপরদিকে তিনি বাংলা ও ব্রজবুলিতে বৈষ্ঞবপদও রচনা করেছেন।
কবি ‘মুকীম’ তার সম্বন্ধে লিখেছেন-
গৌরবাসী রৈল আমি
রোসাঙ্গের ধাম
কবিগুরু মহাকবি
আলাওল নাম।
যদিও কবি
আলাওলের রচনা অনুবাদ প্রধান তবুও তার অনুবাদ মৌলিক রচনার সমপর্যায়ের। এই অসাধারণ
প্রতিভাবান কবি, মহাকবি আলাওল আনুমানিক ৭৬ বছর বয়সে ১৬৭৩
খৃস্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।
শাহসূফী মুজাদ্দিদে যামান আবুবকর সিদ্দিকী(রহ.)
চৌদ্দশতকে
উপমহাদেশে যে সমস্ত পীরে কামেলের পরিচয় আমরা পাই, ফুরফুরা শরীফের
পীর হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী(রহ.) নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বর্তমান
সময়ে ভারত উপমহাদেশে এত ব্যাপকভাবে গৃহীত আর কোন ব্যক্তি হতে পারেন নি। যার কারণে
তিনি উভয় বাংলায় মুসলমানতো বটেই হিন্দুদের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হন।
সত্যি কথা বলতে কি এখনো পর্যন্ত তাঁর মুরীদগণ বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ইসলাম
প্রচারের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এই সূফী শ্রেষ্ঠ ও ইসলাম প্রচারক আবু বকর
সিদ্দিকী(রহ.) পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার ফুরফুরায় ১২৫৩ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
যেটা বর্তমানে ফুরফুরা শরীফ নামে পরিচিত। জন্মের মাত্র ৯ মাস পর তিনি পিতৃহারা হন।
তাঁর পিতার নাম ছিল গোলাম মুকতাদীর। মাতা মুহব্বতুন্নিসা এতিম পুত্র আবু বকর
সিদ্দিকী(রহ.) কে লালন পালন করেন এবং তাঁর সুশিক্ষার ব্যবস্থা করেন।
হযরত আবু বকর
সিদ্দিকী(রহ.) ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। প্রথমে সিতাপুর মাদরাসা, পরবর্তীতে হুগলী মুহসিনিয়া মাদরাসায় পড়ালেখা করেন। কৃতিত্বের সাথে তিনি
মুহসিনিয়া মাদরাসা থেকে তদানীন্তন মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রী জামাতে উলা পাশ
করেন। পরে কলকাতা সিন্ধুরিয়া পট্টির মসজিদে হাদীস, তাফসীর ও ফিকাহ
অধ্যয়ন করেন। মাওলনা বিলায়েত (রহ.) এর নিকট কলকাতা নাখোদা মসজিদে তিনি মানতিক
হিকমা প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি মদীনা শরীফে যান। সেখানে তিনি হাদীস ও
হাদীস সম্বন্ধে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। দেশে ফিরে তিনি একনাগাড়ে ১৮ বছর অধ্যয়ন
অব্যাহত রাখেন। এমনকি নিরলস অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি ইসলাম ও অন্যান্য বিষয়ে
প্রকৃত পান্ডিত্য অর্জন করেন এবং কুতুবুল ইরশাদ হযরত ফতেহ আলী(রহ.) এর নিকট বয়’আত হয়ে ইলমে তাসাওফের সকল তরীকার পূর্ণ কামিলিয়াত হাসিল করেন এবং খিলাফত লাভ
করেন।
তিনি শরীয়তের
একান্ত পাবন্দ একজন পীরে কামিল ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শরীয়ত ব্যতীত মারিফত হয় না। এজন্যই বাংলা, আসামে তাঁর
অগণিত মুরীদও একই পন্থা অবলম্বন করে জীবন যাপন করেন। তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে, শুধু পীরের সন্তান হলেই পীর হওয়া যায় না। তিনি যে বংশের হউন না কেন যদি শরীয়ত
মারিফত ইত্যাদিতে কামিল হন তবে তিনিই পীর হতে পারেন।
হযরত আবু বকর
সিদ্দীক(রহ.) ছিলেন একজন সুবক্তা। যার কারণে তিনি বাংলা আসামের গ্রামে গ্রামে
প্রতিটি অলিগলিতে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করতে পেরেছিলেন। তিনি ক্ষেত্র বিশেষে
কলমও ধরেছেন। তাঁর লেখা কাওলুল হক(উর্দূ) এবং অছীয়ৎনামা(বাংলা) প্রকাশিত হয়েছে।
জানা যায় তিনি আল-আদিররাতুল-মুহাম্মদিয়া নামে আরবীতে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেটি অপ্রকাশিত।
শিক্ষা
বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ
চেষ্টা এবং সহযোগিতায় অসংখ্য মক্তব মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। যে সময়ে ভারতীয়
মুসলমানগণ ইংরেজী শিক্ষার প্রতি অনীহা পোষণ করতো তিনি ইংরেজী শিক্ষার জন্য এদেশের
মুসলমানদের প্রতি জোর আহবান জানান। তিনি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার
জন্য মাদরাসার পাঠ্য তালিকার সংস্কারের জন্য দাবী জানান। তিনি পর্দার সাথে নারীদের
শিক্ষা জরুরী বলেও মত প্রকাশ করেন। এমনকি নারীদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে
তোলার জন্যও তিনি উপদেশ দেন। একটি তথ্য অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে
৮০০ মাদরাসা ও ১১০০ মসজিদ স্থাপন করেন। ১৯২৮ সালে কলিকাতা আলীয়া মাদরাসার যে প্রথম
গভর্নিং বডি গঠিত হয় তিনি তার সদস্য নির্বাচিত হন।
তিনি ইসলামী সমাজ
হতে শিরক বিদআত ও অনৈসলামিক কার্যকলাপ উচ্ছেদের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এজন্য ১৯১১
সালে তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় ‘আঞ্জুমানে ওয়াজীন’ নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। যার কাজ ছিল মুসলিম সমাজ হতে কুসংস্কার দূর
করার জন্য ওয়াজের ব্যবস্থা করা,
খৃস্টান
মিশনারীদের অপপ্রচারের জবাব দেওয়া এবং অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করা।
তিনি যমিয়তে
উলামায়ে হিন্দ-এর বাংলা আসামের সভাপতিও ছিলেন। এ সময়ে তিনি আযাদী আন্দোলনে যোগ
দেন। ইসলামী রাজনীতির ব্যাপারে তিনি পরিষ্কার বলেছেন, “রাজনীতির ক্ষেত্র হইতে আলেমদিগকে সরিয়া পড়িবার জন্য আজ মুসলিম সমাজে নানাবিধ
অন্যায় ও বে-শরা কাজ হইতেছে।”
পরে ‘জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলা আসাম’ গঠন করেন।
১৯৩৮ সালের
প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি তাঁর মুরিদান ও সাধারণ মুসলমানদের মুসলিম লীগ প্রার্থীকে
ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার আহবান জানান।
তিনি তৎকালীন
সময়ে প্রকাশিত মুসলমানদের পত্র-পত্রিকাগুলোকেও সহযোগিতা প্রদান করেন। তাঁর সরাসরি
পৃষ্ঠপোষকতায় যে সমস্ত পত্রিকা প্রকাশ হয় তা হল-সাপ্তাহিক মিহির ও সুধাকর, মাসিক নবনূর, সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, সাপ্তাহিক সোলতান, সাপ্তাহিক মুসলিম হিতৈষী, মাসিক ইসলাম দর্শন, সাপ্তাহিক হানাফী, মাসিক শরিয়তে ইসলাম প্র্রভৃতি।
বাংলা চতুর্দশ
শতাব্দীর নকীব, সমাজ সংস্কারক, ইসলাম প্রচারক, মুজাদ্দিদ, অলিয়ে কামিল এদেশের মুসলমানদের নয়নের মণি
হযরত মওলানা আবু বকর সিদ্দিকী(রহ.) দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর ১৩৪৫ বাংলা সনের ৩
চৈত্র মোতাবিক ১৯৩৯ সালের ১৭ মার্চ শুক্রবার সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ফুরফুরা শরীফের মিয়া পাড়া মহল্লায় তাঁকে দাফন করা হয়। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখ এখানে এছালে সওয়াব অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর খলীফাদের মধ্যে অন্যতম
হচ্ছেন-মওলনা রুহুল আমীন, শর্ষিণার পীর মওলানা নেছারুদ্দীন, মওলানা আহমদ আলী এনায়েতপুরী(যশোর), মওলানা আবদুল
খালেক, মওলানা সদরুদ্দীন, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ,
মওলানা হাতেম
আলী, দ্বারিয়াপুরের পীর মওলানা শাহ সূফী
তোয়াজউদ্দীন আহমদ(রহ.) প্রমুখ।
No comments:
Post a Comment